গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা ও খাবার তালিকা

আপনি প্রথমবার মা হতে চলেছেন আপনাকে স্বাগতম। কারন প্রত্যক মেয়ে চাই তার জীবনে এই দিনটা আসুক। গর্ভাবস্থায় প্রত্যেক নারীর জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রথমবার মা হওয়ার অনুভূতিটাই আলাদা। পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনের যেন খুশির শেষ থাকে না প্রথমবার মা হওয়ার সংবাদ শুনে। সেই সাথে কিছু চিন্তারও কারণ থাকে। ৪০ সপ্তাহের এই গর্ভকালকে মোট তিন ভাগে ভাগ করা হয়। ০- ১৩মাস বা তিন মাসকে ফার্স্ট টাইম স্টোর বলা হয়।
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা ও খাবার তালিকা

গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা ও খাবার তালিকা কি হবে এটা নিয়ে পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন থাকে। প্রিয় পাঠক আর নয় দুশ্চিন্তা, কারন আমার এই পোষ্টের মাধ্যমে, গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা ও খাবার তালিকা এবং গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের ওষুধ লক্ষণ বাচ্চা নড়াচড়া এবং সহবাস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা ও খাবার তালিকা

প্রিয় পাঠক, প্রথমেই আমি আলোচনা করব গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সর্তকতা সম্পর্কে।প্রথম তিন মাস কে ফাস্ট টাইমেস্টার বলা হয়। এ সময় গর্ভবতী মায়ের শরীরে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন দেখা দেয় । এ সময়ে গর্ভবতী মায়ের বমি বমি ভাব, অতিরিক্ত ক্লান্তি, স্তন নরম ও ভারী অনুভব করা, ঘনঘন প্রসব হওয়া, খাবারে অরুচি ইত্যাদির লক্ষণ বা সিনড্রোম দেখা যায়।

ফার্স্ট ট্রাইমেস্টারঃ(০-১৩ সপ্তাহ)

  • এ সময় গর্ভবতী মা এবং গর্বে থাকা অনাগত শিশুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই প্রথম তিন মাসেই শিশুর শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ পতঙ্গ গঠন এবং বিকাশ ঘটে। জন্মগত ত্রুটির পাশাপাশি গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এ সময়ে বেশ কিছু বিষয়ে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
  • গর্ভধারণের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু করে ১২ তম সপ্তাহ পর্যন্ত কে বলা হয় ফাস্ট টাইমেস্টার
  • এক গবেষণায় দেখা গেছে অধিকাংশ গর্ভপাত এই সময়ের মধ্যে হয়ে থাকে
  • তাই ফার্স্ট টাইমেস্টার সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ
  • এ সময় বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্যসহ প্রচন্ড গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হতে পারে
  • এ সময় মাথা ঘোরা সহ প্রচন্ড পেট ব্যাথা হতে পারে
  • এ সময় সিঁড়ি বেয়ে ওঠা ভারী জিনিস বহন করা, ও ঠান্ডা লাগা এ বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে হবে
  • কাপড় ধোয়া, বাড়ি ও বাড়ির আঙ্গিনা ঝাড়ু দিয়া ইত্যাদি কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে
  • প্রথম তিন মাস লং জার্নি না করাই ভালো
  • এ সময় বড় বড় ধাপ না দিয়ে ছোট ছোট ধাপ দিয়ে চলাফেরা করতে হবে
  • রাস্তা খারাপ হলে বা উঁচু নিচু হলে গাড়িতে না গিয়ে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে
  • এ সময় অ্যালকোহল, ধূমপান মদ্যপান থেকে বিরত থাকতে হবে
  • এ সময় আপনাকে একটি ডাক্তার নির্বাচন করে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলাফেরা করতে হবে। ডাক্তার নির্বাচনের সময় মনে রাখতে হবে যে ডাক্তারের সাথে আপনি সহজে যোগাযোগ করতে পারবেন সেরকম ডাক্তার নির্বাচন করতে হবে।
  • হরমোনের পরিবর্তনের কারণে স্তন বড় হতে থাকে সেই সাথে স্তন ব্যথা ও নরম হতে থাকে
  • সন্তান গর্ভধারণের ফলে কিছু শারীরিক পরিবর্তন দেখা দেয়। সন্তান সাধারণত জরায়ুতে ধারণ করা হয় এবং জরায়ু মুত্র নারীর উপরে থাকে। তাই গর্ভে থাকা সন্তান বড় হওয়ার সাথে সাথে মূত্রনালীর উপর কিছুটা চাপ পড়ে। ফলে বেশি বেশি প্রস্রাব হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • এ সময় রক্তচাপের তারতম্য ঘটে। কারো রক্তচাপ বেড়ে যায় আবার কারো রক্তচাপ কমে যায়। এ সময় অনেকের সুগারের পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলাফেরা বা খাবার গ্রহণ করতে হবে।
  • এ সবাই ঘুমের পরিমাণ বাড়িয়ে দিন। দিনে ৮ থেকে ১০ ঘন্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
  • গর্ভস্থ শিশুর বড় হবার সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই এ সময় মেজাজটা খিটখিটে হয়ে থাকে। এ সময় পরিবারের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে যাতে সে বেশি উত্তেজিত না হয়।
উপরে বর্ণিত গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা গুলো অনুসরণ করার পাশাপাশি অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলাফেরা খাবার ইত্যাদি গ্রহণ করতে হবে।

গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের খাবার তালিকা

প্রিয়,পাঠক এতক্ষণ আমরা জানলাম,গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের কি কি সর্তকতা অবলম্বন করতে হয়। কি কি বিষয় মেনে চলতে হয় এবং কি কি বিষয়ে এড়িয়ে চলা ভালো ইত্যাদি । এখন আমরা জানবো, গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের খাবার তালিকা, এ সময় গর্ভবতী মাকে কি ধরনের খাবার বা কেমন খাবার দেওয়া উচিত,এ বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো ইনশাআল্লাহ। তাহলে আসুন দেরি না করে এ বিষয়গুলো জেনে নেই।


গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাস খুব বেশি খাবারের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু খাবার তালিকায় সুষম ও পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার থাকতে হবে। এ সময় খেতে হবে প্রচুর পরিমাণে ফল সবজি ও পানি এবং আয়রন যুক্ত খাবার।

আশ জাতীয় খাবার

এ সময় গর্ভবতী মায়ের জন্য আশ জাতীয় খাবার খুবই উপকারী ও গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় গর্ভবতী মায়ের জন্য হজমের সমস্যা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য একটি কমন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আর এই কষ্ট কাঠিন্য গর্ভপাতের একটি অন্যতম কারণ। তাই এ সমস্যার সাথে থেকে মুক্তি পেতে বেশি বেশি আয়োযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন, ওট মুখ মোটর ব্রকলি ইত্যাদ।

প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার

এ সময় অবশ্যই গর্ভবতী মাকে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে। যেমন মাছ-মাংস দুধ ডিম অবশ্যই খাদ্য তালিকায় থাকতে হবে। সকল ধরনের মাছ খাওয়া বা গ্রহণ করা যাবে কিন্তু কিছু কিছু সামুদ্রিক মাছ না খাওয়ায় ভালো। এ সময় গর্ভবতী মায়ের দৈনিক প্রায় ৭০ থেকে ১০০ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন হয়। তাই এ সময় অবশ্যই পরিমাণমতো প্রোটিনযুক্ত খাবার দিতে হবে। তবে এ সময় চর্বিযুক্ত মাংস এড়িয়া চালাই ভালো।

ভিটামিন যুক্ত খাবার

এ সময় গর্ভস্থ সন্তান আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। এবং মায়ের খাবার থেকেই সে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করে। তাই গর্ভবতী মাকে এই সময় অবশ্যই ভিটামিন যুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে।

ভিটামিন এ

এ সময় ভিটামিন এ যুক্ত খাবার খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। যেমন কালারফুল শাকসবজি, ফল কলিজা পরিমাণ মতো গ্রহণ করতে হবে।এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ থাকে।তাই এ ধরনের খাবার গ্রহণ করতে হবে।

ভিটামিন বি

ভিটামিন বি যুক্ত খাবার অবশ্যই খাদ্য তালিকা রাখতে হবে। যেমন দুধ ডিম দুধের তৈরি বিভিন্ন খাবার দই মাখন পনির ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি থাকে।

ভিটামিন বি নাইন

প্রথম তিন মাসে গর্ভবতী মায়ের জন্য ভিটামিন বি নাইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন বি নাইন সম্মিলিত খাবার গুলোর মধ্যে রয়েছে শস্য গোটা শষ্য ডাল বাদাম ইত্যাদি।

ভিটামিন সি

এ সময় ভিটামিন সি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভিটামিন। কারণ গর্ভস্থ শিশুর হাড় গঠনে ভিটামিন সি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টক জাতীয় ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে যেমন আমলকি আমড়া বাদামি লেবু, কাঁচা মরিচ শাকসবজি ইত্যাদ।

ভিটামিন ডি

প্রথম তিন মাস ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার গর্ভবতী মায়ের জন্য অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময় শিশুর দৈহিক গঠন শুরু হয়। তাই এ সময় খাবার তালিকায় ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার অবশ্যই রাখতে হবে। যেমন সবুজ শাকসবজি পাকা ফল ইত্যাদি।

মিনারেলস জাতীয় খাবার

এ সময় গর্ভবতী মায়ের জন্য অতিরিক্ত খাবার এবং ভিটামিনও মিনারেল জাতীয় খাবারে প্রয়োজন হয়।যেমন আয়রন ক্যালসিয়াম জিংসমৃদ্ধ খাবার।

আইরন

এ সময় গর্ভবতী মা কি অবশ্যই আয়রনযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। কারন এ সময় গর্ভবতী মায়ের শরীরে আয়রনের ঘাটতি দেখা দেয়। আয়রনসমৃদ্ধ খাবার যেমন ডিম কলিজা সবুজ শাক কলমি শাক, কচু শাক শুকনো ফল ডালিম বেদনা, গুড় ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে।আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের বেশি আয়রনের ঘাটতি দেখা দেয়। সেই সাথে দেখা দেয় বিভিন্ন জটিলতা। যেমন সময়ের আগেই শিশুর জন্ম হওয়া, অটিজম শিশুর জন্ম দেয়া ইত্যাদি। তাই অবশ্যই প্রতিদিন আয়রনযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে।

ক্যালসিয়াম

এ সময় ক্যালসিয়াম গর্ভবতী মায়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। কারণ এ সময় গর্ভবতী মায়ের গর্ভস্থ শিশুর দৈহিক গঠন ও বিকাশ ঘটতে থাকে। তাই এ সময় ক্যালশিয়াম জাতীয় খাবার যেমন দুধ, ডিম, দই, পনির, ব্রকলি বাঁধাকপি,কাটাযুক্ত মাছ তপু পালং শাক ডুমুর ডিম তেল তিশী ইত্যাদি। এছাড়াও বিভিন্ন লাল শাকসবজি শুটকি লাউ শাক ,ডাল ছোট মাছ সোয়াবিন ইত্যাদি প্রতিদিন খাবার তালিকায় থাকতে হবে।

ফ্লইড

এ সময় ফ্লইড জাতীয় খাবার প্রচুর পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত। দিনে কমপক্ষে (২.৫-৩)লিটার পানি পান করতে হবে এছাড়া বিভিন্ন রকম ফলের রস জুস খেতে হব।অর্থাত এ সময় তরল জাতীয় খাবার বেশি বেশি গ্রহণ করতে হবে। যতটা সম্ভব পানি পান করতে হবে।

জিংক

শরীরের কোষ গঠনে জিংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই এ সময় জিংক জাতীয় খাবার অবশ্য গ্রহণ করতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন ৪৪ মিলিগ্রাম জিংকের প্রয়োজন হয়। তাই এ সময় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সাপ্লিমেন্ট হিসেবে জিংক ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দিবেন। এছাড়াও আপনি খাবার তালিকায় জিংক সমৃদ্ধ খাবার যেমন ডাল ছোলা ডিম আমল্ড বিচি চিনাবাদাম মুরগির মাংস গরুর মাংস দুধ ইত্যাদি রাখতে হবে।

এ সময় গর্ভবতী মা শুধু একাই থাকেন না তার সাথে আরেকটি মানুষের অস্তিত্ব থাকে।তাই খাবার থেকে শুরু করে চলাফেরা খাবার ইত্যাদি বিষয়ে অবশ্য সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এবং প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর ডাক্তারের কাছে গিয়ে চেকআপ করে নিতে হবে। গর্ভবতি মায়ের শরীর এবং শিশু কেমন আছে ইত্যাদি বিষয়ে জানতে হবে। এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সেবা গ্রহণ করতে হবে।

শেষ কথা

আপনার অনাগত সন্তান কতটা মেধাবী হবে ,সুস্থ হবে,তা নির্ভর করে গর্ভবতী মায়ের খাদ্যভাসের উপর।একটি শিশু সুস্থ, সবল,এবং কতটা মেধাবী তা নির্ভর করে গর্ভবতী মায়ের খাদ্য চলাফেরা ওর যত্নের উপর। তাই গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা ও খাবার তালিকা সম্পর্কে অধিক সচেতন হতে হবে। প্রিয় পাঠক, আমার এই পোষ্টের মাধ্যমে গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা ও খাবার তালিকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি এতক্ষণে আমার এই পোস্টটি পড়ে তা বুঝতে পেরেছেন এবং আপনার বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারবেন। আপনি যদি এতটুকু উপকৃত হন তাহলেই আমার লেখাটা সার্থক হবে। সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। আজ আর নয় ,কথা হবে অন্য কোন পোস্ট নিয়ে। আল্লাহ হাফেজ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url